পঞ্চাশের দশকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ে ভীত ইউরোপীয় দেশগুলো একটি জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর এই জোট ই পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পরিণত হয়। এখানে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কী? ইউরোপীয় ইউনিয়নের গঠন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য Formation and Objectives of European Union সম্পর্কে জানব।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের ইতিহাস
১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল প্যারিসে এক চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপীয় কয়লা ইস্পাত পরিষদ (European Coal and Steel Community - ECSE) গঠিত হয়। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সূত্রপাত ঘটে আরো পরে।
১৯৫৭ সালের ২৫ ম বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যাণ্ডস, ইতালি, ফ্রান্স ও সাবেক পশ্চিম জার্মানি এ ছয়টি রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত 'রোম চুক্তি' (Rome Treaty) অনুযায়ী, ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারি ইইসি (EEC-European Economic Community) আত্মপ্রকাশ করে।
একই তারিখে আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপীয় আণবিক শক্তি সম্প্রদায় Euratom (European Atomic Energy Community) গঠন করা হয়।
১৯৬৭ সালে মার্জার চুক্তি' (Merge Treaty) মোতাবেক ECSE, EEC এবং Euratom এই তিনটি সম্প্রদায়কে একসাথে ইউরোপীয় সম্প্রদায় (European Community) নামে অভিহিত করা হতো।
১৯৯২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডস-এর ম্যাসট্রিকট-এ European Community-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তি ম্যাসট্রিকট চুক্তি (Maastricht Treaty) নামে পরিচিতি পায়।
১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর চুক্তিটি কার্যকর হয়। এ সময় থেকেই European Community রূপান্তরিত হয়ে European Union (EU)-এ পরিণত হয় এবং একক মুদ্রা হিসেবে Euro চালু হয়। বর্তমানে European Union-এর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদরদপ্তর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
পারস্পরিক স্বার্থে শুল্ক হার হ্রাসের মাধ্যমে দেশসমূহের উৎপাদিত পণ্যের সুলভ ও সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠা এবং বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সাধারণ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গঠনমূলক সংলাপ ও পরামর্শ এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপন ও আত্মরক্ষার কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান অঙ্গ সংস্থা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান অঙ্গসংস্থা ৬টি।
১. ইউরোপীয় কাউন্সিল, ২. ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ৩. ইউরোপীয় কমিশন, ৪ কাউন্সিল অব ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ৫. কোর্ট অব জাস্টিস অব দ্য ইউরোপিয়ান ৬. ইউরোপীয় কোর্ট অব এডিটরস।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থবিষয়ক সহযোগী সংস্থা
ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (বর্তমান প্রেসিডেন্ট জার্মান রাজনীতিবিদ ওয়ের্নার হয়ের (Werner Hoyer), ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইতালিয় অর্থনীতিবিদ Mario Draghi (ম্যারিও দ্রাঘি) ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সদস্য দেশ
বর্তমান সদস্য দেশ; বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সাইপ্রাস, চেকপ্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মাল্টা, পোল্যান্ড, স্লোভানিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভাকিয়া। সদস্য প্রত্যাশী দেশ: আলবেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া, বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা
ইউরো মুদ্রা: "ইউরো' হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের একক মুদ্রা। এ মুদ্রার জনক রবার্ট মুন্ডেল। ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি ইউরো চালু হয়। তখন ১১টি দেশ বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া ও ফিনল্যান্ড ইউরো মুদ্রা গ্রহণ করে।
২০০১ সালের ১ জানুয়ারি গ্রিস, ২০০৭, সালের ১ জানুয়ারি স্লোভেনিয়া, ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি সাইপ্রাস ও মাল্টায় ইউরো মুদ্রা চালু হয়। স্লোভাকিয়ায় ইউরো মুদ্রা চালু হয় ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি এস্তোনিয়ায় ইউরো মুদ্রা চালু হয়। এ নিয়ে ইউরো মুদ্রা চালুকৃত দেশের সংখ্যা ১৯।
ইইউ-এর নতুন সদস্য হওয়ার শর্তাবলি
ইইউ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর নতুন সদস্য হতে হলে কোনো রাষ্ট্রের যে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হয় সেগুলো হলো:
১. গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা প্রদানকারী প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা।
২. আইনের শাসন।
৩. মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার।
৪. গ্রহণযোগ্য বাজার অর্থনীতি বা প্রতিযোগিতামূলক বাজারের চাপ গ্রহণের সক্ষমতা এবং
৫. অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা মেনে নেওয়া।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ইউরোপ তার অর্থনীতিকে গড়ে তোলার কাজে উঠে পড়ে লাগে। ইইউ'র ব্যানারে ইউরোপের দেশগুলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করে। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা এর সুফল পায়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু আঞ্চলিক নয় বরং ইউরোপ এখন এক বিশ্বশক্তি। বিশেষ করে ইউরো চালু হবার পর থেকে ইউরোপের অর্থনীতি আরো গতিশীল হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইইউ'র কর্মকাণ্ডে সমর্থন দিয়ে আসছিল এবং ইইউও এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ করে আসছিল। আর এসব করতে গিয়ে ইইউ রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে এসেছে সযত্নে। এ কারণেই ইইউকে বলা হয় 'অর্থনৈতিক দৈত্য, রাজনৈতিক বামন'।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ইইউ'র বিশ্ব রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একজন রাজনৈতিক সহযোগী তৈরি হওয়া। এতদিন যেমন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো যৌথভাবে নেওয়া হতো এখন তেমনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ইইউ'র পরামর্শ নেওয়া যাবে।
একজন কংগ্রেস সদস্যের মতে, এর ফলে একটি স্থিতিশীল বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে ইইউকে পাওয়া যাবে। এ কারণেই বলকান অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট ইইউকে সঙ্গী করেছে।
এ প্রচেষ্টাকে দেখা হচ্ছে Test Case হিসেবে, অর্থাৎ এ প্রচেষ্টা যদি সফল হয় তবে যুক্তরাষ্ট্র ইইউকে সাথে নিয়ে ভবিষ্যতে আরো কর্মসূচি হাতে নেবে। যেমন—বিশ্ব পরিবেশ রক্ষা কর্মসূচি। অনেকের মতে, এ সখ্যতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তখনই মন্তব্য করা যাবে যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে উভয়ের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হবে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে।
আর অনেকে মনে করছেন, বর্তমান বিশ্বে চীন, রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থা নেই। একমাত্র ইইউ-ই হতে পারো যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত প্রতিপক্ষ।
তাছাড়া ইইউ তার নিজস্ব সামরিক বাহিনীও গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জোরেসোরে। আর তা যদি গঠিত হয় তবে শক্তিসাম্যের প্রতিযোগিতায় আবার মেরুকরণের সূত্রপাত হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
Post a Comment