বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অন্যতম। এখানে আমরা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা এবং কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কি
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এদেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় জাতীয় জীবনে নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে (১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- "প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে"।
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রিপরিষদের অন্তত নয়-দশমাংশ সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত হবেন জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে।
শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, স্থানীয় পর্যায়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার নীতি এবং সংবিধানে বর্ণিত সকল নির্বাচন গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হবে।
তাই বাংলাদেশ সংবিধানে নির্বাচন ব্যবস্থার সংগঠন, নির্বাচনি আইন ও নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। নির্বাচন ব্যবস্থা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় ।
নির্বাচন কমিশনের গঠন
সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করবেন, সেরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপ্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করবেন।নির্বাচন কমিশনের গঠন, মেয়াদ ও পদচ্যুতি সম্পর্কিত যে সমস্ত বিধানাবলি আছে সেগুলো হল:
১. একাধিক নির্বাচন কমিশনার নিয়ে কমিশন গঠিত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার সভাপতিরূপে কাজ করবেন।
২. সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে কোনো নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ তাঁর কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছর হবে।
৩. প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এমন কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগলাভের যোগ্য হবেন না।
৪. অন্য কোনো নির্বাচন কমিশনার অনুরূপ পদে কর্মাবসানের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনাররূপে নিয়োগলাভের যোগ্য হবেন, তবে অন্য কোনোভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন।
৫. সংসদ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলি রাষ্ট্রপতি, আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করবেন সেরূপ হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না।
৬. কোনো নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করতে পারবেন।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও কার্যাবলি
সংবিধানের ১১৯ (১) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী —
ক. রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন।
খ. সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে।
গ. সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবেন, এবং
ঘ. রাষ্ট্রপতি পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করবেন।
উপরিউক্ত দফাসমূহের নির্ধারিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত যেরূপ দায়িত্ব এই সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে, নির্বাচন কমিশন সেরূপ দায়িত্ব পালন করবেন।
১২০ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই বিভাগের অধীন নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করবেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন আরও যে সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যাবলি পালন করে থাকে সেগুলো হলো:
১. সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ।
২. রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য বিতরণকৃত মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাছাই করা এবং এ সংক্রান্ত অভিযোগের মীমাংসা করত চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা ।
৩. নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা, ফলাফল একত্রীকরণ এবং সরকারি গেজেট প্রকাশ করা।
৪. নির্বাচনি অভিযোগ-মোকদ্দমা মীমাংসার জন্য নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল গঠন।
৫. নির্বাচনি আচরণবিধি ঘোষণা।
৬. নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা।
৭. প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় পর্যবেক্ষণ করা।
৮. রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পাদন করা।
৯. নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ।
১০. সংবিধান অনুযায়ী এবং আইনের দ্বারা অর্পিত অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা।
রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচন
ক. রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে উক্ত পদ শূন্য হলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের পূর্ববর্তী ষাট থেকে নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদে।
খ. মৃত্যু, পদত্যাগ বা অপসারণের ফলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে নব্বই দিনের মধ্যে তা পূর্ণ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংসদ সদস্যের নির্বাচন
ক. মেয়াদান্তে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাবার পরবর্তী নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচন সম্পর্কে সংসদের ক্ষমতা
সংবিধানের ১২৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংসদের যথাযথ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়সমূহ সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত বা নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের বিধান প্রণয়ন করতে পারবেন। সংবিধানের ১২৫ নং অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও-
ক. সংবিধানের ১২৪ নং অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলে বিবেচিত নির্বাচনি এলাকার সীমা নির্ধারণ, কিংবা অনুরূপ নির্বাচনি এলাকার জন্য আসন বণ্টন সম্পর্কিত যেকোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
খ. সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোনো আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে প্রণালিতে নির্বাচনি দরখাস্ত ব্যতীত রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন বা সংসদের কোনো নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না ।
নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সহায়তা প্রদান
সংবিধানের ১২৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনকে রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের এবং ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন করা হয়। ৯ মার্চ, ২০০৮ অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচন কমিশনকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পৃথক করা হয়।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রধান হচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং প্রশাসনিক প্রধান নির্বাচন কমিশন সচিব। সাংবিধানিকভাবে এটি স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
Post a Comment