লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪০ কি? - লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য।

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অন্যতম। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং সমর্থন করেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসস্থান বা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয় এই লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে। 
লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪০

লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি।এমনকি লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। এখানে আমরা লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪০ - Lahore Resolution, 1940 কি?, লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানব। 

লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট :

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর পরই এ আইনের কার্যকারিতা শুরু হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করে। তখন থেকেই হিন্দুরা ভারতবর্ষে 'হিন্দু রাজ্য' প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং তাদের ক্রিয়াকলাপে ধর্মান্ধতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। এতে মুসলমানদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হয় এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ওপর নানারকম অত্যাচার চলতে থাকে।

ঠিক সেই সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন। তিনি মুসলমানদের মধ্যকার মতানৈক্য ও বিভ্রান্তি দূর করে মুসলিম লীগকে একটি সত্যিকার প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফলে মুসলিম লীগ আগের তুলনায় অধিক পরিমাণে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠন, বোর্ড স্থাপন ও সদস্যভুক্তির চাঁদার হার কমিয়ে দেয়ার ফলে মুসলিম লীগ সাধারণ জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ সালে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, মুসলিম লীগ ভারতবর্ষে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সবিশেষ আগ্রহী। এরপর তিনি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যস্থাকে গ্রহণ করা যায় না বলে ১৯৩৯ সালে অভিমত প্রকাশ করেন। এরূপ রাজনৈতিক পটভূমিকায় ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এক অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এ অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারণ করা। এ অধিবেশনে ঐতিহাসিক 'লাহোর প্রস্তাব' গৃহীত হয়, যা পরবর্তীকালে 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে অভিহিত হয়।এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং সমর্থন করেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান।

লাহোর প্রস্তাব কি?

লাহোর প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, 'সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এ অধিবেশনে বলা হয় কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এ দেশে কার্যকরী হবে না বা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যদি তা নিম্নলিখিত মূলনীতিভিত্তিক না হয়; যথা— প্রয়োজনবোধে সীমানার পুনর্বিন্যাস সাধন করে এবং ভৌগোলিক দিক হতে পরস্পর নিকটবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর সমন্বয় সাধন করে; যেমন— ভারতের উত্তর পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোকে একত্রিত করে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। এদের অঙ্গরাজ্যগুলোও সার্বভৌম এবং স্বায়ত্তশাসিত হবে'। (Resolved that it is the considered view of the session of All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to the Muslims, unless it is designed on the following basic principle, viz, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted with the such territorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the North-Western and Eastern zones of India Should be grouped to constitute 'Independent States' in which the constituent units shall be autonomous and sovereign)। 

এ প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয় যে, অঙ্গরাজ্যগুলোর সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শাসন সংক্রান্ত অধিকার রক্ষার জন্য ভারতবর্ষে ভবিষ্যৎ সংবিধানে বিভিন্ন রক্ষাকবচের সুনির্দিষ্ট পন্থার উল্লেখ থাকতে হবে। উপরন্তু এতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ভারতবর্ষের যেসব অংশে মুসলমানগণ সংখ্যালঘু, তাদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শাসন সংক্রান্ত সব অধিকার সংরক্ষণের সুস্পষ্ট উল্লেখ সংবিধানে থাকতে হবে।

লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য:

লাহোর প্রস্তাবকে বিশ্লেষণ করলে মুসলিম লীগের দাবি-দাওয়া সম্পর্কিত কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়ে ওঠে, যথা-

১. ভৌগোলিক দিক হতে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে পৃথক পৃথক অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হবে।

২. ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বভারতের যেসব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে।

৩. এভাবে গঠিত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো সম্পূর্ণরূপে স্বায়ত্তশাসিত হবে।

৪. ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সাথে পরামর্শক্রমে তাদের শাসনতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৫. দেশের যেকোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

৬. অঞ্চল বা প্রদেশগুলো নিজেদের এলাকার প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে সব ক্ষমতার অধিকারী হবে।

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব :

বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণের স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস ও শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ধারা লক্ষ করলে দেখা যায় যে, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবি, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদি সবকিছুই ছিল লাহোর প্রস্তাবে গৃহীত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বহিঃপ্রকাশ। যেভাবে লাহোর প্রস্তাব বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পথকে সুগম করেছিল সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত: ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। লাহোর প্রস্তাবে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, পূর্ব ভারতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হিসেবে বর্ধিষ্ণু পূর্ব বাংলাকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হবে। সুতরাং, এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, লাহোর প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

২. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন হরণ করে একে ঔপনিবেশিক শাসনে পরিণত করে। অথচ লাহোর প্রস্তাবে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে শোষণ করা ছাড়াও তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য নীল নকশা প্রণয়ন করে। এহেন পরিস্থিতিতে বাঙালি নেতারা দাবি করেন যে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এ দাবি পরবর্তীতে শক্তিশালী স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ লাভ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।

Post a Comment

Previous Post Next Post