তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড মর্ল এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো কতৃক ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রণীত হয়, মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন, ১৯০৯ । এই জন্য গভর্নর জেনারেল লর্ড মলে এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো কতৃক এ আইন প্রণীত হওয়ায় এই আইন মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। Morley-Minto Reforms Act, 1909 আইন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় পরিস্থিতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ ছিল। এখানে আমরা মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন কী, মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের ধারা বা বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের গুরুত্ব সমালোচনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন কী?
ব্রিটিশ ভারতে শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯০৯ সালের মলে-মিন্টো সংস্কার আইন। তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মলে এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোর নামানুসারে এ আইনের এইরূপ নামকরণ করা হয়।
১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল বা পরিষদ আইনকে একটি সাংবিধানিক প্রস্তরফলক হিসেবে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ আইন পরিষদ ছিল। "অকার্যকর আইন পরিষদ"। সরকারের সিদ্ধান্তের উপর আইন পরিষদের প্রভাব খুবই কম ছিল। এছাড়াও ১৮৯৬-৯৭ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও ১৮৯৮ সালে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবে প্রায় ১ লক্ষ ৭৩ হাজার লোক মারা যায়। এই অবস্থাতেও ব্রিটিশ সরকার উদাসীন ছিল।
আবার লর্ড কার্জনের অবিবেচনাপ্রসূত নীতির ফলে ভারতীয় জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন সময়ে ভারতে কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। সরকারের চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও নির্যাতনমূলক নীতির ফলে এ গোষ্ঠীর জন্ম হয়। এ গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ মনে করতেন যে সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও সক্রিয় আন্দোলন ছাড়া স্বরাজ লাভের কোনো পথই খোলা নেই। আধুনিক ভারতীয় গবেষক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেন যে, বড় লাট ও ভারত সচিব উভয়ের যুগ্ম উদ্যোগেই এ শাসন সংস্কার প্রবর্তিত হয়।
১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের ধারা বা বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
১. এ আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৬৯ করা হয়।
২. এ আইনে বড় বড় প্রদেশ যেমন: বাংলায় ৫২ জন এবং বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি প্রতি প্রদেশের আইন পরিষদের ৪৭ জন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদেশের আইন পরিষদে সর্বাধিক ৩০ জন অতিরিক্ত সদস্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
৩. এ আইনের মাধ্যমে আইনসভাগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং সদস্যগণ আইনসভার বিতর্কে, বাজেট আলোচনায়, প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় এবং ভোটদানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেন।
৪. এ আইনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রথা স্বীকৃত হয় এবং এর সাথে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন প্রথাও প্রবর্তিত হয়।
৫. এ আইনের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি গৃহীত হয়। এ আইনে অধিকাংশ সদস্যই নির্বাচিত হতো পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে।
৭. এ আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার ধারণা স্বীকৃত হয়।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের গুরুত্ব ও সমালোচনা :
১৯০৯ সালের আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরদের পরিষদে প্রথমবারের মতো ভারতীয়রা অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।
এতদসত্ত্বেও মলে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতবাসীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এতে যে নির্বাচন পদ্ধতি অনুসৃত হয় তা ছিল পরোক্ষ। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও জনগণের মধ্যে তেমন যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভবপর হয়নি।
সুতরাং বলা যায় যে, ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া পূরণে কার্যত ব্যর্থ হয়েছিল এ সংস্কারের ফলে ভারতীয়রা লাভ করে 'প্রভাব' 'ক্ষমতা' নয়। ডক্টর জাকারিয়া বলেন, '১৯০৯ সালের মলে-মিন্টো সংস্কার ভারতীয় জনগণকে দিয়েছে 'বন্ধু'র বদলে 'প্রচ্ছায়া'। তিনি আরো বলেন যে, মর্লে-মিন্টো আইনে নির্বাচন নীতিকে গ্রহণ করা সত্ত্বেও, গণতন্ত্রবিরোধী সাম্প্রদায়িক নির্বাচন চালু করা হয়। আইন পরিষদগুলোর দরজা গুটি কয়েক ভারতীয়দের প্রবেশের জন্য সামান্য ফাঁক করা হয় মাত্র।'
Post a Comment