১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারেনি। ফলে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিকট এ আইন গ্রহণযোগ্য ছিল না। পরবর্তীতে ভারত সচিব মন্টেগু ১৯১৭ সালের শেষ পর্যায়ে ভারতবর্ষে আসেন এবং তৎকালীন বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডের সাথে এ দেশবাসীদের স্বায়ত্তশাসন দাবি প্রসঙ্গ সহ শাসনতান্ত্রিক সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ Government of India Act, 1919 রূপে প্রবর্তিত হয়। ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ Government of India Act, 1919 মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন নামেও পরিচিত।
ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ কি? এবং মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন গঠনের প্রেক্ষাপট:
ভারতবর্ষে যখন ১৯০৯ সালে মলে-মিন্টো সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে এ ধরনের গুঞ্জন চলছিল ঠিক এমনি সময় ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে এবং ব্রিটিশ সরকার এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য- সহানুভূতি ব্রিটিশ সরকারের নিকট অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তখন এ দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্রিটিশ সরকার পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের আশ্বাস বাণী প্রদান করে। ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদনের পরে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস যৌথভাবে ভারতবাসীদের স্বায়ত্তশাসন দাবি করলে ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৯১৭ সালের ২০ আগস্ট ব্রিটেনের কমন্সসভায় তদানীন্তন ভাইসরয় মি. মন্টেগু ভারতবর্ষের স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্র করে নিম্নোক্ত বক্তব্য তুলে ধরেন— “মহামান্য সরকারের নীতির সাথে ভারত সরকারের পূর্ণ সম্মতি রয়েছে, যার লক্ষ্য হলো শাসন বিভাগের প্রত্যেক শাখায় ভারতীয়দের সহযোগিতা বৃদ্ধি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্রমোন্নতি সাধন করা যাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভারত দায়িত্বশীল সরকার হাসিল করতে সক্ষম হয়।"
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবাসীরা তাদের যথাশক্তি নিয়োগ করে ব্রিটিশ সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য করলে ভারতবাসীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিমিত্তে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সচিব মন্টেগুকে সরেজমিনে সবকিছু তদন্ত করে ব্রিটিশ সরকারকে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশানুসারে ভারত সচিব মন্টেগু ১৯১৭ সালের শেষ পর্যায়ে ভারতবর্ষে আসেন এবং তৎকালীন বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডের সাথে এ দেশবাসীদের স্বায়ত্তশাসন দাবি প্রসঙ্গ সহ শাসনতান্ত্রিক সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। তারা উভয়েই ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে কিছু কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সমস্ত বিষয়কে চিহ্নিত করে সুপারিশ আকারে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। রিপোর্টটিকে ভিত্তি করে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি আইন পাস করে। এটা ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত। মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী উক্ত আইন পাস হয়েছিল বলে একে মন্টেগু- চেমসফোর্ড সংস্কার আইনও বলা হয়।
ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ বা (মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন) এর বৈশিষ্ট্যসমূহ :
ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ আইনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে ব্রিটেনে ভারতীয় হাইকমিশনারের পদ সৃষ্টি করা হয়। তিনি ব্রিটেনে ভারতীয় ছাত্র ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়াদিও তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি ৫ বছরের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক নিয়োগ লাভ করতেন।
২. ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সভায় পরিণত করা হয়। উচ্চ কক্ষের নামকরণ করা হয় রাষ্ট্রীয় পরিষদ' (Council of State) এবং নিম্ন কক্ষের নামকরণ করা হয় 'ব্যবস্থাপক সভা' (Legislative Assembly) উচ্চ কক্ষের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬০ জন এবং তন্মধ্যে ৩৪ জন নির্বাচিত সদস্য ও বাকি ২৬ জন বড়লাট বা গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হতেন। নিম্ন কক্ষের মোট সদস্যদের ১৪৫ জনের মধ্যে ১০৫ জন ছিলেন নির্বাচিত ও বাকি ৪০ জন ছিলেন মনোনীত। ক্ষমতার দিক হতে নিম্ন কক্ষ উচ্চ কক্ষের চেয়ে অধিকতর ক্ষমতাবান ছিল।
৩. ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ এর মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাদেশিক আইনসভা সমূহের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। তাছাড়া এ আইনে আরও বলা হয় যে, প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা শতকরা ৭০ জনের কম হবে এবং সরকারি সদস্যদের সংখ্যা ২০ জনের অধিক হবে না।
৪. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক এ দুভাগে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে নাস্ত করা হয়।
৫. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের সুযোগ প্রদান করা হয়। মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়াও পাঞ্জাবের শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপীয়গণও পৃথক নির্বাচনের অধিকার লাভ করে।
৬. ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ প্রদেশে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। এ ব্যবস্থা অনুসারে প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে দু ভাগে ভাগ করা হয়। সংরক্ষিত বিষয় (Reserved Subject) এবং হস্তান্তরিত বিষয় (Transferred Subject)। আইন-শৃঙ্খলা অর্থ, রাজস্ব প্রভৃতি বিষয়সমূহ সংরক্ষিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি হস্তান্তরিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। সংরক্ষিত বিষয়গুলো প্রাদেশিক গভর্নর তার শাসন পরিষদের মাধ্যমে শাসন করতেন। এক্ষেত্রে তিনি মন্ত্রিপরিষদের কোনো পরামর্শ নিতেন না। পক্ষান্তরে, হস্তান্তরিত বিষয়গুলো প্রাদেশিক গভর্নর তার মনোনীত সদস্য ও মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শক্রমে শাসন করতেন।
৭. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রাদেশিক আইন পরিষদের শতকরা ৮০ জন সদস্য নির্বাচিত হতেন এবং শতকরা ২০ জনের অধিক সরকারি সদস্য থাকতেন না। তবে প্রাদেশিক আইন পরিষদে তিন প্রকার সদস্য ছিলেন। নির্বাচিত সদস্য, সরকারি সদস্য ও মনোনীত সদস্য। ভোটাধিকার খুবই সীমিত ছিল।
৮. ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ এর মাধ্যমে সরকারের আয়ের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এটি ছাড়া কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের আয়ের উৎস নির্ধারণ করা হয়। আয়কর ও বাণিজ্যিক কর কেন্দ্রের হাতে এবং ভূমি রাজস্ব ও মানকদ্রব্যের ওপর আবগারি শুল্ক প্রদেশের হাতে প্রদান করা হয়।
৯. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের মাধ্যমে গভর্নর জেনারেলকে সাহায্য করার জন্য ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। এদের মধ্যে অন্তত ৩ জন ভারতীয় সদস্য থাকবেন বলে স্থির করা হয়।
১০. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে ভারত সচিবের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়। তার অত্যধিক ক্ষমতার কারণে তাকে 'হোয়াইট হলের প্রতাপশালী মুঘল সম্রাট' বলে অভিহিত করা হতো।
১১. ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে গভর্নর জেনারেলকে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। তিনি আইন পরিষদ প্রণীত যেকোনো আইন বাতিল করতে পারতেন।
১২. ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ১ জন চেয়ারম্যান এবং ৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে একটি 'পাবলিক সার্ভিস কমিশন' গঠন করা হয়।
ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের গুরুত্ব:
যদিও ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ (Government of India Act, 1919) বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কিন্তু, ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন অনুসারে প্রদেশে যে আইন পরিষদ গঠিত হয় তার আয়তন বৃদ্ধি পেলেও পরিষদের আইন প্রণয়ন এবং অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা নানাভাবে সীমিত করা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বিচার করলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের ক্ষেত্রে এ আইনের ত্রুটি ছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সাংবিধানিক সংস্কারের দিক দিয়ে এ আইনকে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলা হয়। এ আইনকে ভারতের সাংবিধানিক বিকাশের ইতিহাসে এক মহান দিক নির্দেশনা বলে বর্ণনা করা যায়।
Post a Comment