মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা, ১৯৪৬ - The Cabinet Mission Plan, 1946

ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা বা মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি মন্ত্রিমিশন কমিশন গঠন করেন। যদিও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় রাজনৈতিক দলের অসহযোগিতার কারণে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা তথা কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 


আমরা এখানে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা, ১৯৪৬ - The Cabinet Mission Plan, 1946 কি? মন্ত্রী মিশন কেন ভারতে এসেছিল, মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনার প্রধান কে ছিলেন, মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব কী কী ছিল?, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় কেন?, মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা সদস্য সংখ্যা কতজন ছিল এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

ঐতিহাসিক মন্ত্রিমিশন' বা 'কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা কি?

ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনে ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি (Clement, Richard Attlee) মন্ত্রিসভার তিনজন প্রভাবশালী সদস্য নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। 

একই বছরের ২৪ মার্চ এ তিন সদস্য তথা স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, লর্ড পেথিক লরেন্স এবং এ. ভি আলেকজান্ডার ভারতে আগমন করেন। ৩ এপ্রিল কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং ৪ এপ্রিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মন্ত্রিমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের বিভিন্ন চেষ্টা করেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে মন্ত্রিমিশনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। 

অবশেষে ১৯৪৬ সালের ১৬ মে উক্ত মিশন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা সম্বলিত একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এটিকেই 'ঐতিহাসিক মন্ত্রিমিশন' বা 'কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা' হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা বা কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার প্রস্তাব সমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ:

ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা বা কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। এ পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো;

১. ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার (ইউনিয়ন সরকার) গঠিত হবে। এ ইউনিয়ন সরকারের ওপর প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ বিষয়াদি পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে। এছাড়া এ ইউনিয়ন সরকারের কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আদায়ের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে।

২. প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি শাসন বিভাগ ও একটি আইন বিভাগ থাকবে। ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশগুলোর ও দেশীয় রাজ্যসমূহের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উক্ত বিভাগদ্বয় গঠিত হবে। কেন্দ্রীয় আইনসভার বা বিভাগে কোনো সম্প্রদায়ের মৌলিক স্বার্থ সংশিষ্ট কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোটদানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন লাগবে।

৩. কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত বিষয় ছাড়া অবশিষ্ট সকল বিষয়ের ওপর যথাক্রমে প্রাদেশিক সরকারের ও দেশীয় রাজ্য সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

৪. কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা অনুসারে ভারতের প্রদেশগুলোকে তিনটি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করা হবে। যথা:
  • ক গ্রুপ: বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্ত প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার এবং উড়িষ্যা – এ ছয়টি প্রদেশ এ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হবে। 
  • খ গ্রুপ: পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধু প্রদেশ এ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হবে।
  • গ গ্রুপ: বাংলা ও আসাম নিয়ে হবে গ গ্রুপ।
৫. প্রত্যেক গ্রুপের একটি আইনসভা ও একটি শাসন বিভাগ থাকবে। কী কী প্রাদেশিক বিষয় সাধারণ শাসনাধীনে রাখা হবে, তা প্রত্যেক গ্রুপ নির্ধারণ করবে।

৬. দশ লক্ষ লোকের জন্য একজন প্রতিনিধি এ নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকটি গ্রুপের আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্য বা প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ গঠিত হবে। এ গণপরিষদ বা সংবিধান প্রণয়ন পরিষদই সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান রচনা করবে।

৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে এবং গ্রুপ সংবিধানে এমন একটি বিশেষ পদ্ধতি বা ব্যবস্থা রাখতে হবে যার মাধ্যমে ১০ বছর পর যেকোনো প্রদেশ তার আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের শর্তাবলি পুনর্বিবেচনার দাবি করতে পারবে ।

৮. এ পরিকল্পনা অনুযায়ী সংবিধান রচনার পূর্ব পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গভর্নর জেনারেল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে পারবেন।

৯. এ পরিকল্পনায় বলা হয় যে, নতুন সংবিধান প্রণীত হবার অব্যবহিত পরে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক আইনসভা গঠিত হলে সেই আইনসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেকোনো প্রদেশ তার সংশ্লিষ্ট গ্রুপ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে ।

১০. কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা অনুযায়ী সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনিয়ন গঠিত হবার পর দেশীয় রাজাগুলোর ওপর ব্রিটিশ সম্রাটের সার্বভৌম ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে এবং প্রত্যেক রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে।

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণসমূহ :

 ১৯৪৬ সালের মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনাকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতীয়দের স্বাধীনতা প্রদানের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু, এটি অনেকটা ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি ছিল। মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ব্যর্থতার কারণগুলো নিম্নরূপ—

১. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতের ভবিষ্যত সংবিধান রচনার দায়িত্ব গণপরিষদকে দেয়া হলেও এর সদস্যরা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত নন। তাছাড়া পণপরিষদের ৯৩ জন প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক রাজন্যবর্গ ছিলেন যা অনেকটাই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া

২. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় দেশীয় রাজ্যগুলোর সামন্ততন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দেশীয় রাজ্যগুলোতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি অনুপস্থিত ছিল ।

৩. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় ভারতকে দুটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল, একটি হিন্দু প্রধান অঞ্চল ও অন্যটি দেশীয় রাজ্যসমূহ নিয়ে গঠিত অঞ্চল - এ চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হবার কথা বলা হয়। আর এটি ছিল অবাস্তব ও জটিল ।

৪. ভারতের রাজনৈতিক জটিলতা এড়ানোর জন্য যেখানে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দরকার সেখানে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের চেষ্টা হয়।

৫. ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন পরিস্থিতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো ব্যবস্থা মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় উল্লেখ ছিল না।

৬. কেবিনেট মিশন পরিকল্পনায় গণপরিষদকে সার্বভৌম ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কেননা গণপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত না হলে তা অকার্যকর থেকে যাবে।

৭. কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পশ্চাতে অন্যান্য বিভিন্ন কারণের পাশাপাশি মুখ্য কারণ হচ্ছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অসহযোগিতা। অর্থাৎ উভয় রাজনৈতিক দলই তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে ভেবে অবশেষে এ পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করে।

এভাবে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনায় বিভিন্ন ত্রুটি এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এ পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা বা কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার গুরুত্ব:

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা বা কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও এর মাঝেই পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি উদ্ভবের সম্ভাবনা নিহিত ছিল । কারণ কেবিনেট মিশন পরিকল্পনায় যে তিনটি গ্রুপের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে খ ও গ এই দুই গ্রুপে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।

Post a Comment

Previous Post Next Post