১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৮৯২ (Indian Council Act, 1892) প্রণীত হয়। যা ভারতবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে আমরা ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৮৯২ (Indian Council Act, 1892) এর গুরুত্ব এবং বৈশিষ্ট্য ও ধারা সম্পর্কে জানব।
ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৮৯২ (Indian Council Act, 1892) প্রনয়ন এর প্রেক্ষাপট
১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। এ আইনে প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভা গঠন করা হয়নি। সাধারণত উচ্চবিত্ত, জমিদার বা অভিজাত শ্রেণির লোকজনকেই গভর্নর জেনারেল আইন পরিষদের সদস্য মনোনীত করতেন।
এর ফলে এ আইনসভার কার্যক্রমে সাধারণ ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ব্রিটিশ সরকারও অনুধারন করতে সক্ষম হয় যে, এ আইন জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করলেও আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হয়নি।
ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ সময় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। ইংরেজি শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভ্যুদয় ঘটে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ শ্রেণির নেতৃত্বেই ১৮৮৫ সালে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতীয়দের বিভিন্ন দাবি এবং বর্ণনার বিষয়গুলো আরও জোরালো ও স্পষ্ট হয়ে। এ প্রেক্ষিতে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন (Lord Dufferin) একটি পুনর্গঠন প্রস্তাব উত্থাপন করেন ।
তিনি আইন পরিষদগুলোর সংস্কারের উদ্দেশ্যে স্যার জেমস চেসলি, স্যার চার্লস এচিশন ও জেমস ওয়েস্টল্যান্ডকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।
কমিটির সুপারিশের আলোকে তৎকালীন ভারত সচিব লর্ড ক্রস-এর উদ্যোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্যাপক আলোচনার পর ১৮৯২ সালে সংশোধিত আকারে বিলটি আইনে পরিণত হয়, যা '১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন' (Indian Council Act, 1892) নামে খ্যাত।
এ আইনে ভারতবর্ষের আইন পরিষদসমূহের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে বিভিন্ন বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৮৯২ এর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
১৮৯২ সালের কাউন্সিল আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
১. ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে সর্বনিম্ন ১০ এবং সর্বোচ্চ ১৬ জন অতিরিক্ত সদস্য নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। ভারত সচিবের সম্মতিক্রমে গভর্নর জেনারেল এ সকল অতিরিক্ত সদস্য নিয়োগ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
২. কেন্দ্রীয় পরিষদে অতিরিক্ত সদস্যদের মধ্যে ৬ জনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা হতে পারবে না বলে স্থির করা হয়।
৩. প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। এক্ষেত্রে বৃহৎ প্রদেশগুলোর সদস্যসংখা বৃদ্ধি করে ২০ জনে এবং ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে ১৫ জনে উন্নীত করা হয়
৪. কেন্দ্র ও প্রদেশের বেসরকারি সদস্যসংখ্যাও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করা হয়। এক্ষেত্রে আইন পরিষদগুলোতে সরকারি সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য ১০ জনের বেশি বেসরকারি সদস্য মনোনীত হতে পারবে না বলে স্থির করা হয়।
৫. আইন পরিষদের সদস্যদেরকে শর্তসাপেক্ষে সরকারের অর্থনৈতিক রিপোর্ট আলোচনা বা সমালোচনা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
৬. স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর বা প্রাদেশিক আইন পরিষদের বেসরকারি সদস্যগণ কর্তৃক মনোনীত ৪ জন সদস্যকে কেন্দ্রীয় পরিষদে বা কাউন্সিলে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। এক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
৭. ১৮৯২ সালের কাউন্সিল আইনে আইন পরিষদগুলো সরকারি আয়-ব্যয় সম্পর্কিত হিসাব সম্বন্ধে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা করার অধিকার লাভ করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে আইন পরিষদের সদস্যদের জনস্বার্থ বিষয়ক প্রশ্ন করার অধিকারও দেওয়া হয়।
৮. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের অতিরিক্ত সদস্যদের মধ্যে ৫ জন নির্বাচিত সদস্যের কথা বলা হয়। যারা পৌরসভা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও অন্যান্য বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে মনোনীত হতেন।
ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৮৯২ এর গুরুত্ব:
১৮৯২ সালের কাউন্সিল আইনটির কিছু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও ভারতীয়গণের জন্য এবং বিশেষ করে শাসনতান্ত্রিক বিকাশে এর গুরুত্ব কম ছিল না।
বস্তুত ১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের চেয়ে ১৮৯২ সালের আইন ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯২ সালের ভারত কাউন্সিল আইনে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।
এ আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বেসরকারি সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি। বেসরকারি সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার লাভের পথ সুগম হয়। এ কাউন্সিল আইনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম নির্বাচন নীতি গৃহীত হয়েছিল।
১৮৯২ সালের কাউন্সিল আইনটিকে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা গঠনের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়। পূর্বে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু এ আইনের বলে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, আশুতোষ মুখার্জী, রাসবিহারী ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভাইসরয়ের আইন পরিষদে যোগ দেয়ার সুযোগ পান।
১৮৬১ সালের আইনে সদস্যদের সরকারের আর্থিক নীতি সম্পর্কে আলোচনা বা সমালোচনা করার অধিকার ছিল না। কিন্তু ১৮৯২ সালের আইনে আইন পরিষদের সদস্যদের সরকারের অর্থনৈতিক রিপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা এবং সমালোচনা করার সুযোগ দেয়া হয়। ফলে সরকার তাদের ভুলভ্রান্তি দূর করার ব্যাপারে যত্নবান হয়।
এই আইনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, '১৮৯২ সালের আইন ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল জর্জ নাথানিয়েল কার্জন (George Nathaniel Curzon) এ আইন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'এ বিল কোনো মহতী ব্যবস্থা নয়, তবে এটা যে একটা নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।'
Post a Comment