আমাদের দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি যে পাখিটির সাথে পরিচিত সেটি হলো শালিক পাখি। এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে শালিক পাখি চেনে না। শহরে, গ্রামে গঞ্জে, বন জঙ্গলে সব জায়গায় শালিক পাখি দেখা যায়। এমনকি মানুষের বাসা বাড়িতে ও খাবারের খোঁজে ঢুকে পড়ে। আজকে আমরা বিভিন্ন প্রজাতির শালিক পাখির বৈশিষ্ট্য ও পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য জানবো।
শালিক পাখির পরিচিতি
আমাদের অতি পরিচিত পাখি শালিক। শালিক পাখির ইংরেজি নাম স্টারলিং ( Sterling)। শালিক Sturnidae গোত্রভুক্ত Passeriforme বর্গের একটি পাখি। Sturnidae একটি লাতিন শব্দ। যার অর্থ শালিক। শালিক পাখি মূলত ছোট ও মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। বড় আকৃতির শালিক ময়না নামে পরিচিত। শালিক পাখির শিল্পী হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। এরা মধুর সুরে গান গাইতে পারে। এমনকি এরা মানুষ ও অন্যান্য পশু পাখির ডাক ও নকল করতে পারে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে শালিক পাখির বাস। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে ছোট ও মাঝারি আকারের এই পাখির দেখা মেলে। আমাদের দেশে সাধারণত বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত, বনজঙ্গল ও বাসা বাড়ির আশেপাশে এদের দেখা পাওয়া যায়।
শালিক পাখির বৈশিষ্ট্য
বিশ্বে বিভিন্ন প্রজাতির শালিক রয়েছে, এসব প্রত্যেক টি প্রজাতির রয়েছে বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য। কোনটা আকারে ছোট, কোনটা আকারে বড় আবার কোনটা বা মাঝারি। দেহের রঙের বেলায় ও এদের মধ্যে বেশ তারতম্য রয়েছে। কোনটা কালো, কোনটা বাদামী আবার কোনটাতে বা রয়েছে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ।
শালিক এর সরতন্ত্র বেশ জটিল। এজন্য এরা মানুষের আওয়াজ নকল করতে পারব। শালিক বিভিন্ন জীব জন্তুর শব্দও নকল করতে পারে। এরা গলার স্বর শুনে মানুষ চিনতে পারে। প্রায় সকল প্রজাতির শালিকই গান গাইতে পারে।
যেহেতু বিশ্বে প্রায় ১০৪ প্রজাতির শালিক রয়েছে। সেজন্য সকল প্রজাতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব না। আমরা এখানে শুধু আমাদের দেশীয় কয়েকটি প্রজাতির শালিকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো।
শালিক পাখির প্রজাতি
পৃথিবীতে প্রায় ১০৪ প্রজাতির শালিক রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ১৮ টি ও আমাদের বাংলাদেশে ১২ টি প্রজাতির শালিক রয়েছে। আমাদের দেশের স্থায়ী কিছু প্রজাতি হলো: ভাত শালিক, কালো শালিক, গাং শালিক, চিত্রা শালিক, কাঠ শালিক, ঝুটি শালিক, গো শালিক, বামন শালিক এবং ব্রাহ্মণী ময়না। এসব প্রত্যেকটি প্রজাতির রয়েছে বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য। নিচে আমরা এসব প্রজাতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানব।
ভাত শালিক
শালিক এর বিভিন্ন প্রজাপতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত প্রজাতি হলো ভাত শালিক। ভাত শালিকের বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres tristis। বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এদের বেশি দেখা যায়। ভাত শালিক বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এবং এর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এরা মানুষের আশেপাশে থাকতে বেশি পছন্দ করে।
পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে ভাত শালিক এর বসবাস। ভাত শালিক কে নূন্যতম বিপদগ্রস্ত পাখি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীতে কোন কোন দেশে ভাত শালিকের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, সে দেশে ভাত শালিক কে মানবস্বার্থ, বাস্তুতন্ত্র, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভাত শালিক শিকার করা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে নিষিদ্ধ।
গাং শালিক
গাং শালিক শালিকের বিভিন্ন প্রজাতি গুলোর একটি। এই প্রজাতির শালিক ভাত শালিকের থেকে আকারে কিছুটা ছোট। গাং শালিকের ইংরেজি নাম Bank Myna । আর এর বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres ginginianus। গাং বা নদ নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায় ও বাসা তৈরি করে এজন্য এর নাম গাং শালিক। এরা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে।
গাং শালিক দেখতে প্রায় ভাত শালিকের মতো হলেও এর কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একে ভাত শালিকের থেকে আলাদা করেছে। ভাত শালিকের চোখের পিছনে হলুদ রং এর ত্বক থাকে কিন্তু গাং শালিকের লাল রঙের ত্বক থাকে। এছাড়াও ঝুটি শালিকের সাথেও ভাত গাং শালিকের কিছুটা মিল রয়েছে।
গো শালিক
গো শালিক বা গোবরে শালিক বাংলাদেশে প্রাপ্ত শালিকের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে অন্যতম। এদের ইংরেজি নাম Myna বা Asian Pied Starling। গো শালিকের বৈজ্ঞানিক নাম Sturnus contra। ভাত শালিকের মত এদের ও প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়। এরা মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। এজন্য শহর, গ্রাম, বন জঙ্গল সব জায়গায় এদের দেখা যায়।
গো শালিক বা গোবরে শালিক সাধারণত গরু, মহিষ ইত্যাদির গোবর থেকে পোকা খেয়ে থাকে, এজন্য এদের নাম গো শালিক বা গোবরে শালিক। এরা বিভিন্ন রকমের আওয়াজে ডাকে। সন্ধ্যার সময় বাশ বাগানে একসঙ্গে কিচিরমিচির শব্দে ডাকতে থাকে। এদের সারা শরীরে কালো ও সাদা রঙের পালোক থাকে। পুরুষ এবং স্ত্রী শালিক দেখতে একই রকম। বাচ্চা শালিকের দেহে বাদামি রঙের পালক দেখা যায়। এরা শুকনো লতাপাতা, ঘাস, খড় এসব দিয়ে বাসা বানায়।
কাঠ শালিক
শালিকের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে কাঠ শালিক অন্যতম। এই প্রজাতির শালিক দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। কাঠ শালিকের বৈজ্ঞানিক নাম Sturnus malabaricus। কাঠ শালিক দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে এরা বসবাস করে।
এরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ফল ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে। গাছের কোটরে এরা বাসা বানাতে পছন্দ করে। বসন্ত থেকে বর্ষাকালে এরা প্রজনন করে থাকে।
শালিক পাখির খাদ্যাভ্যাস
যাইহোক, আমরা এতক্ষণ বিভিন্ন প্রজাতির শালিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম। শালিক পাখি আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। কিন্তু এসব প্রজাতির মধ্যে কিছু কিছু প্রজাতি আছে যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণে অকারণে পাখি শিকার, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার। বন জঙ্গল উজাড় করা এসব কারণে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির পাশাপাশি শালিক পাখিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের শালিক পাখি রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এই পাখি পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা বর্ণনা করা অসম্ভব। শালিক পাখি সহ এরকম অন্যান্য পাখি রক্ষা না করলে বাস্তুতন্ত্রে এর খারাপ প্রভাব পড়বে, এতে পৃথিবীর প্রানী জগৎ হুমকির মুখে পড়বে অদূর ভবিষ্যতে।
Post a Comment