১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।আর এই স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সেসময় বাঙালি জাতির উপর অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। তারই অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে তারা ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ২৫ মার্চ এর সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
তার এই ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরের ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নামে পরিচিত। বিশ্বের মধ্যে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা রয়েছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। আমরা এখন স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
স্বাধীনতার ঘোষণা কি?
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়াকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বা Declaration of Independence বলা হয়। ধানমন্ডির বাসা থেকে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেস এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এই ঘোষণায় তিনি সকলকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পাঠকৃত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ:
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ইংরেজি ঘোষণাটি হলো:
“THIS MAY BE MY LAST MESSAGE, FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FROM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED.” - Sheikh Mujibur Rahman (March 26, 1971)
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ:
এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি যে, যে যেখানে আছ, যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। - শেখ মুজিবুর রহমান, ২৬ মার্চ ১৯৭১।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্বাধীনতার ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কি?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কি তা আমরা এই আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারব।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার একটি ঘোষণাপত্র জারি করে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of independence) নামে পরিচিত, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশ পরিচালনার অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে উক্ত ঘোষণা পত্রটি জারি করা হয়েছিলো।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারকে অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী শপথ বাক্য পাঠ করান। শপথ বাক্য পাঠকালীন অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি আনুষ্ঠানিক ভাবে পাঠ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে।পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উক্ত ঘোষণা বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম তফসিলে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এই ঘোষণায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত মুজিবুর সরকারকে বৈধতা প্রদান করা হয়। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন ও ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর বলে অনুমোদন দেয়া হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত, বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল;
এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন;
এবং যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন;
এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন;
এবং যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান;
এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে;
এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে;
এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি,...........
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বলতে কি বোঝায়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বলতে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পাঠকৃত ঘোষণাকে বোঝায়।২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসা থেকে ওয়্যারলেস মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বলতে কি বোঝায়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বলতে বোঝায় যে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকার পরিচালনার জন্য যে আদেশ জারি করা হয়।
মুক্তির ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণা কি একই?
মুক্তির ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণা এক জিনিস। স্বাধীনতার সমার্থক শব্দ হচ্ছে মুক্তি। সুতরাং, মুক্তির ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণা এক জিনিসকেই নির্দেশ করে।
Post a Comment