গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ

বর্তমান সময়ে গবাদি পশু বিভিন্ন প্রকার মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব রোগের কোন চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। কিছু কিছু রোগের প্রকোপ এত তীব্র যে আক্রান্ত হ‌ওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আক্রান্ত পশু মারা যায়। ঠিক এমনই এক মারাত্মক রোগ হলো লাম্পি স্কিন ডিজিজ‌ বা এল‌এসডি। গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগ বর্তমানে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ


কোন কোন ক্ষেত্রে এই রোগ মহামারী আকার ধারণ করছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কিন্তু আমরা যদি এইসব রোগের ব্যাপারে একটু সচেতন হ‌ই, তাহলেই এসব রোগের প্রকোপ থেকে আমাদের প্রিয় পশু গুলোকে বাঁচাতে পারবো। আমরা এখানে লাম্পি স্কিন ডিজিজ কি, গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর চিকিৎসা, লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর ভ্যাকসিন ইত্যাদি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ কি?

লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এল‌এসডি মূলত গরু ও মহিষের ভাইরাসজনিত একটি সংক্রামক রোগ। মশা ও মাছির মতো কীট পতঙ্গ কর্তৃক এক পশু থেকে আরেক পশুতে এই রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। গরু ও মহিষ উভয়ই এই রোগে আক্রান্ত হলেও মহিষের তুলনায় গরু এ‌ই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগে আক্রান্ত পশুর মাংস ও দুধের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। সঠিক ভাবে আক্রান্ত পশুর চিকিৎসা না করলে শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত পশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ কিভাবে ছড়ায়? 

লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এল‌এসডি বিভিন্ন ভাবে ছড়াতে পারে, এসব কারণে গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : মশা ও মাছির মাধ্যমে, নতুন পশুর মাধ্যমে, আক্রান্ত পশুর মাধ্যমে।

মশা ও মাছির মাধ্যমে

মশা ও মাছিরা সাধারণত গরু ও মহিষের শরীর থেকে রক্ত শুষে খেয়ে থাকে। কোন গরু বা মহিষ যখন লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সেই পশুর শরীর হতে যেসব মশা ও মাছিরা রক্ত শুষে খায়, তারা যখন আবার সুস্থ কোন পশুর শরীর হতে রক্ত খায়, সেসময় লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগের ভাইরাস সুস্থ পশুর রক্তনালীতে প্রবেশ করে ও ভাল পশুকেও উক্ত রোগে আক্রান্ত করে। এখানে মশা ও মাছি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। যদিও মশা ও মাছির মাধ্যমে অর্থাৎ বাহকের মাধ্যমে এই রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে কিন্তু বাহক অর্থাৎ মশা ও মাছি এই রোগে আক্রান্ত হয় না।

আক্রান্ত পশুর মাধ্যমে

এল‌এসডি বা লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগে আক্রান্ত পশু থেকে একটি সুস্থ পশুতে বিভিন্ন ভাবে এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। যেমন: আক্রান্ত পশুর মুখ থেকে অনবরত লালা পড়তে থাকে। সেই লালা যদি গরুর খাবারের উপর পড়ে ( খড়, ঘাস ) এবং তা যদি কোন সুস্থ পশু খেয়ে ফেলে তাহলে সেই সুস্থ পশু টিও উক্ত রোগে আক্রান্ত হ‌তে পারে।

এছাড়া আক্রান্ত গাভীর দুধ খাওয়ার মাধ্যমেও বাছুর এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত পশুকে পুশ করা ইনজেকশন এর সুচ যদি কোন সুস্থ পশুকে পুশ করা হয় তাহলে এই রোগ সংক্রমিত হ‌ওয়ার আশঙ্কা থাকে। আক্রান্ত ষাঁড়ের বীজের মাধ্যমেও এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। 

এছাড়া দেখা যায় যে, সাধারণত লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত পশুর চামড়ায় ফোস্কা পড়ে। ফোস্কা যখন চামড়াসহ মাটিতে পড়ে যায় সেখান থেকেও উক্ত রোগের ভাইরাস ছড়াতে পারে।

নতুন পশুর মাধ্যমে

বাজার থেকে নতুন পশু ক্রয় করে নিয়ে আসলে এবং সেই পশু লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হলে খামারের অন্যান্য পশুও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সেজন্য নতুন পশু ক্রয় করার সময় সচেতন থাকতে হবে ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। প্রয়োজন হলে ৪ সপ্তাহের জন্য নতুন পশুকে কোয়ারান্ট্যাইনে রাখতে হবে যাতে অন্যান্য সুস্থ পশুও এই রোগে আক্রান্ত না হয়।
এসব কারণ ছাড়াও খামারে অপরিচিত লোকের প্রবেশ সীমিত করতে হবে। 

লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগের লক্ষণসমূহ


পশু লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হলে বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত কোন পশু লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হলে ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। এল‌এসডি তে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে। প্রথমত নাক ও চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। এরপর আক্রান্ত পশুর শরীরে জ্বর আসে যা পরবর্তী ১ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লসিকা গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।

লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত পশুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেই লক্ষণ টি প্রকট আকারে প্রকাশ পায় সেটি হলো, আক্রান্ত পশুর শরীরে বিভিন্ন স্থানে গুটি সৃষ্টি হয়। যেগুলোর ব্যাসার্ধ ১০-১৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।এল‌এসডি রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত উপরোক্ত উপসর্গ সমূহ দেখা যায়।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগের ফলাফল


বর্তমানে গবাদিপশু যেসব রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এল‌এসডি অন্যতম। মারাত্মক এই রোগে আক্রান্ত হলে গবাদিপশুর যে পরিণাম হয় তা অত্যন্ত মারাত্মক। 

আমরা জানি যে এই রোগে আক্রান্ত হলে পশুর সমস্ত শরীরে গুটি দেখা যায়।এই গুটি গুলো খুব‌ই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। গুটি গুলো সাধারনত চামড়ার ভেতরে ও মাংসের মধ্যে, নাকের মধ্যে , মুখের মধ্যে, গলায় এবং দুধের ওলানে হয়ে থাকে। এগুলো এক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা না করলে গুটি গুলো ফেটে যেতে পারে এবং পরবর্তীতে ফোস্কা পড়তে পারে। 

পায়ে যদি গুটি হয়, সেক্ষেত্রে সেগুলো ফেটে গিয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে যার ফলে পশু হাঁটা চলা করতে পারে না। এছাড়াও গুটি গুলো ফেটে গিয়ে ইনফেকশন সৃষ্ট করলে সেখানে থেকে পুঁজ বের হতে পারে। এবং মাছি সেখানে ডিম দিতে পারে। লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হলে পশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধের উপায় 

আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি যে লাম্পি স্কিন ডিজিজ খুব‌ই মারাত্মক একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগের প্রার্দুভাব থেকে গবাদিপশু কে রক্ষা করতে হলে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন:

লাম্পি স্কিন ডিজিজ আক্রান্ত পশুর সাথে যাতে সুস্থ কোন পশু মিশতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এলাকায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে গবাদিপশুর গোয়াল বা খামার জীবাণু নাশক দ্বারা জীবাণু মুক্ত করতে হবে। আক্রান্ত পশুর ক্ষত স্থান থেকে পরবর্তীতে যে খোসা খসে পড়ে তাতে এই রোগের ভাইরাস কয়েক মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। সেজন্য খুবই সতর্ক থাকতে হবে। 

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, মশা বা মাছি এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। সেজন্য গবাদিপশুর খামার বা গোয়াল সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। যাতে মশা বা মাছির উপদ্রব না হয়। এছাড়াও পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর চিকিৎসা

লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এল‌এসডি রোগে কোন গবাদিপশু আক্রান্ত হলে অতিসত্বর কোন অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে পশু অতি দ্রুত সুস্থতা লাভ করবে।

লাম্পি স্কিন রোগের ঔষধ বা গরুর গায়ে গুটি গুটি রোগের চিকিৎসা

লাম্পি স্কিন রোগের কোন নির্দিষ্ট ঔষধ নেই। প্রাথমিক অবস্থায় অ্যান্টিপাইরেটিক ও অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এই অসুখ ভালো হয়ে যায় ‌।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর হোমিও চিকিৎসা

আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি যে লাম্পি স্কিন ডিজিজ খুব‌ই মারাত্মক একটি ভাইরাসজনিত রোগ। লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগের নির্দিষ্ট কোন ঔষধ নেই। আক্রান্ত পশুর নিয়মিত পরিচর্যা করলে এই অসুখ ভালো হয়ে যায়। এছাড়াও দক্ষ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে পশু অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভ্যাকসিনের দাম

যেসব পশু সবচেয়ে বেশি লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হয় তার মধ্যে গরু অন্যতম। বর্তমানে এই রোগের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে এই রোগের ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।

আমরা এতক্ষণ গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এল‌এসডি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানলাম। লাম্পি স্কিন ডিজিজ কি, কিভাবে ছড়ায়, প্রতিরোধের উপায়, এর চিকিৎসা । আমরা এখানে যা জানলাম সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। অথবা এই রোগে কোন পশু আক্রান্ত হলে অতিদ্রুত কোন অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post