ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭। Indian Independence Act, 1947

ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭। Indian Independence Act, 1947 এর মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে এবং পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়ন নামে আলাদা স্বাধীন দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এখানে আমরা ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর প্রেক্ষাপট, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং এর তাৎপর্য সম্পর্কে জানব।

ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭

ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর প্রেক্ষাপট: 

চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পরস্পর বিরোধী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট রিচার্ড এটলি (Clement Richard Attlee: ৩ জানুয়ারি ১৮৮৩-৮ অক্টোবর ১৯৬৭) ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হাউস অব কমন্সসভায় বক্তৃতা দানকালে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা ঘোষণা করেন। অতঃপর তিনি তার ঘোষণাকে অর্থবহ করার জন্য গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে (Lord Louis Mountbatten) ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠান।

১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন দিল্লিতে আসেন এবং ২৪ মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষের সমস্যা সমাধানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে অতি ব্যাপকভাবে আলাপ-আলোচনায় মিলিত হন; কিন্তু সমস্যার গভীরতা এতই প্রকট ছিল যে, আলাপ-আলোচনায় তিনি সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো পথ খুঁজে পাননি। অবশেষে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতির জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণপূর্বক তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, “ভারত বিভাগ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।" এরপর তিনি এই সিদ্ধান্তকে সামনে নিয়ে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের কাছে ভারত বিভাগের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। কংগ্রেস ভারত বিভাগে রাজি হলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং ১৯৪৭ সালের ২ জুন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ নেতৃবৃন্দের সাথে এক বার্ষিক আলাপ-আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন তিনি তার পরিকল্পনা ভারতবর্ষের জনগণের সামনে তুলে ধরেন। এটাই ৩ জুনের মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে খ্যাত। এরপর ১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কার্যকর করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপিত হয়। এতে 'ভারত ও পাকিস্তান' নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়, যা “ভারত স্বাধীনতা আইন' নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত স্বাধীনতা আইন' পাস করে।

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ :

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে দীর্ঘ প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো:

১. ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন উক্ত সালের ১৪ আগস্ট হতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটায় এবং ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে 'পাকিস্তান' এবং 'ভারত ইউনিয়ন' নামক দুটি নতুন ডোমিনিয়ন সৃষ্টি করে। আইনটি ডোমিনিয়ন দুটির আইনগত সার্বভৌমত্বও সেই সাথে স্বীকার করে নেয়।

২. ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন দুটি ডোমিনিয়নের জন্য দুটি পৃথক গণপরিষদ গঠন করে। এই গণপরিষদ দুটির উপর দুই দেশের শাসনতন্ত্র রচনার ভার অর্পণ করা হয়। যতদিন পর্যন্ত শাসনতন্ত্র প্রণীত না হবে ততদিন উচ্চ গণপরিষদ দুটি স্ব-স্ব দেশের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদরূপে কাজ করবে।

৩. ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে ডোমিনিয়ন দুটি ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত থাকবে কি না সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার তাদের থাকবে ।

৪. ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর ব্রিটিশ রাজ্যের সার্বভৌম ক্ষমতার অবসান ঘটে। দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের ইচ্ছামতো পাকিস্তান বা ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করতে পারবে অথব এরা ইচ্ছা করলে স্বাধীন থাকতে পারবে।

৫. ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন ভারত সচিব পদের বিলুপ্তি ঘটায় এবং পাকিস্তান ও ভারতের সাথে সম্পর্ক রাখার দায়িত্ব কমনওয়েলথ সেক্রেটারির ওপর অর্পণ করে।

৬. এ আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসনের ব্যাপারে উভয় ডোমিনিয়নের জন্য একজন করে গভর্নর জেনারেল থাকে এবং ডোমিনিয়ন কেবিনেটের পরামর্শক্রমে ব্রিটেনের রাজা কর্তৃক তিনি নিযুক্ত হবেন। তবে গভর্নর জেনারেল হবেন একজন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান মাত্র।

৭. এ আইন অনুসারে পাকিস্তান ও ভারত উভয় ডোমিনিয়নের শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত এদের কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রদবদলসহ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন কার্যকরী থাকবে। 

এই রদবদলগুলো নিম্নরূপ :

ক. গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরের 'স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা' ও 'বিশেষ দায়িত্ব' প্রভৃতির অবসান ঘটবে। উভয় ডোমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল নিজ নিজ দেশের মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।

গ. উভয় ডোমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে নিযুক্ত হবেন।

গ. মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুসারে গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক গভর্নরদের নিযুক্ত করবেন।

ঘ. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইনের সাথে সামঞ্জস্যহীন হলেও গণপরিষদের কোনো আইন বাতিল বলে গণ্য হবে না। 

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ১৪ এবং ১৫ আগস্ট কার্যকর করা হয় এবং সেই দিন হতেই ভারত উপমহাদেশে পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রের গণপরিষদকে অবারিত ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বলা বাহুল্য যে, এ আইন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়ন নামে দুটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়ন সংবিধান কার্যকর হয়।

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের তাৎপর্য (Significance of the Indian Independence Act of 1947) :

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হলেও এ আইনের গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। নিম্নলিখিত কারণে ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব অপরিসীম:

১. ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের পথে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বশেষ পদক্ষেপ।

২. এ আইন দ্বারা সুদীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭ সাল) ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

৩. এ আইন দ্বারা গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বিলুপ্ত করায় ভবিষ্যতে ভারত ও পাকিস্তানে সংসদীয় ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

৪. সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়াই এ আইন দ্বারা দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইতিহাসের গতিপথ ধরে নব নব আশা- আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা নিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে এ দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।

৫. এ আইন উপমহাদেশের জনগণের কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, জীবনযাত্রা প্রণালি ও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করে। ফলে শুভ সূচনা হয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায়ের।

৬. এ আইনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এ আইনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়।

পরিশেষে বলা যায়, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন এ উপমহাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিল। এ আইন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে যা সূচিত হয়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইনে তার সমাপ্তি ঘটে। ব্রিটিশ রাজ্যের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে ভারতবর্ষে ভারত এবং পাকিস্তান এ দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে এ আইনে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দিল্লিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে এ পরিষদ ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর অংশ হিসেবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। গণপরিষদে জওহরলাল নেহেরু মন্তব্য করেছিলেন, 'Long years ago we made a tryst with destiny and now the time comes when we shall redeem our pledge, not wholly or in full measure, but very substantially.' এভাবেই ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয় এবং ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ভারত ইউনিয়নের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন লর্ড মাউন্ডব্যাটেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের, নতুন যুগের। নব নব প্রেরণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উপমহাদেশের দুটি দেশ নতুনভাবে তাদের যাত্রা শুরু করে।

Post a Comment

Previous Post Next Post