ঘুঘু পাখির খাবার ও বৈশিষ্ট্য

আমাদের এই সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা দেশ বাংলাদেশ। আর আমাদের এই অপরূপ জন্মভূমিতে বসবাস করে শত সহস্রাধিক পশু পাখি। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঘুঘু পাখি।
 
ঘুঘু পাখির ছবি

গ্ৰাম কিংবা শহর আমাদের দেশের সকল মানুষের কাছেই ঘুঘু পাখি অত্যন্ত সৌখিন পাখি হিসেবে পরিচিত। অনেকে আবার শখ করে ঘুঘু পাখি পালন করা করে থাকেন। গ্রীষ্মের খরতাপে গাছের ছায়ায় বসে থাকা মানুষের মন জুড়িয়ে যায় ঘুঘুর ডাক শুনে। আমরা এখন ঘুঘু পাখি এবং এর বৈশিষ্ট্য ও খাবার সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানব।

ঘুঘু পাখির পরিচিতি

ঘুঘু বাংলাদেশর মানুষের কাছে একটি অতি পরিচিত পাখি। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ঘুঘু পাখির বসবাস। বাংলাদেশে গ্রাম অঞ্চলে এদেরকে দেখা যায়। ফসলের ক্ষেতে, মাঠে, ঘাটে , বনে ও জঙ্গলে এবং মানুষের বসত বাড়ির আশেপাশে সব জায়গাতেই ঘুঘু পাখি দেখা যায়। বিশ্বে প্রায় ৩৬ প্রজাতির ঘুঘু দেখা গেলেও আমাদের বাংলাদেশে এর সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে প্রায় ৬ টি প্রজাতির ঘুঘু দেখা যায়।

ঘুঘু কলম্বিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি পাখি। বিশ্বে কলম্বিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৩১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। আর এর মধ্যে ঘুঘু হলো অন্যতম একটি পাখি। ঘুঘুর ইংরেজি নাম Dove । ঘুঘু Streptopelia গণের অন্তর্ভুক্ত একটি পাখি।

ঘুঘু পাখির বৈশিষ্ট্য

ঘুঘু আমাদের অতি পরিচিত সৌখিন একটি পাখি। অনেক মানুষ ঘুঘুর ডাক শুনতে খুব পছন্দ করেন। সৌখিন এই পাখির রয়েছে নানা রকম বৈশিষ্ট্য। যেহেতু পৃথিবীতে প্রায় ৩৬ প্রজাতির ঘুঘু রয়েছে, এসব প্রত্যেকটি প্রজাতির রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এসব প্রজাতির মধ্যে গায়ের রং, আকার, ডাকার ধরণ অনুযায়ী পার্থক্য রয়েছে।

বিশ্বে প্রায় ৩৬ প্রজাতির ঘুঘু পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এর ৬ টি প্রজাতির দেখা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে যেসব ঘুঘু পাওয়া যায়, সেগুলোর যেসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেসবের ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য 
তুলে ধরা হলো। 

ঘুঘু খুব দ্রুত উড়তে পারে। এরা সাধারণত ঝোপ ঝাড়ে থাকতে পছন্দ করে। কবুতরের সাথে ঘুঘুর বেশ মিল রয়েছে। এরা এক‌ই গোত্রের পাখি। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ঘুঘুর ওজন প্রায় ২৫-৩০ গ্ৰাম হয়ে থাকে। এদের আকার লম্বায় প্রায় ২৮-৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর লেজ বেশ লম্বা হয়ে থাকে।

ঘুঘু লোকালয়ে বাস করলেও এরা একটু আড়ালে থাকে। এরা সাধারণত ঝোপ ঝাড়ে বা মাঝারি উচ্চতার গাছ গুলোতে বাসা বানায়। ঘুঘু জঙ্গল থেকে খড়কুটো ও খোঁচা দিয়ে তাদের বাসা বানায়। এরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বসবাস করে। এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে ঘুঘু তুলনামূলক বেশি ডিম দিয়ে থাকে। এটা তাদের প্রজননের প্রধান সময়। 

একটি ঘুঘু প্রায় ৬ মাস বয়সে ডিম পাড়ার উপযুক্ত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ঘুঘু মধুর সুরে শান্ত কন্ঠে গান গায়। এতে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ঘুঘু আকৃষ্ট হয়। এরপর তারা জোড়া বাঁধে। তারা বাসা বানায় ও কিছু দিনের মধ্যেই ডিম দেয়। ঘুঘু ২ টি করে ডিম দিয়ে থাকে। এদের ডিমের রং সাদা। এদের ডিমের আকার লম্বায় ২.৬ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ১.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বছরে সাধারণত ৩ বার ডিম দিয়ে থাকে। 

ঘুঘুর ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে প্রায় ১৩-১৪ দিন সময় লাগে। ছোট বাচ্চা শস্য দানা খেতে পারে না। প্রথম ২-৩ দিন ঘুঘু তাদের বাচ্চাদের একটি বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়ায় যা ' পিজিয়ন মিল্ক ' হিসেবে পরিচিত। এটি তাদের খাদ্য থলিতে তৈরি একটি বিশেষ ধরনের লালা। যাযা বাচ্চাদের খাওয়ার উপযোগী। এরপর ২-৩ সপ্তাহ পর বাচ্চা উড়তে শিখে যায়।

ঘুঘু পাখি সাধারণত বিভিন্ন ধরনের শস্য দানা ও পোকামাকড় খেতে পছন্দ করে। ঘুঘু কত বছর বাঁচে তা বলা মুশকিল। কারণ বিভিন্ন প্রজাতি ভেদে তা ভিন্ন হতে পারে। তবে ঘুঘু সর্বচ্চো ৫-১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় তিলা ঘুঘু। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির ঘুঘুর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হলো সবুজ ঘুঘু।

ঘুঘুর বিভিন্ন প্রজাতি

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ৩৬ প্রজাতির ঘুঘু পাওয়া গেছে। এসব প্রজাতির মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে পাওয়া যায় ৬ টি প্রজাতির ঘুঘু। বাংলাদেশে যে ৬ টি প্রজাতির ঘুঘু পাওয়া যায় সেগুলো হলো: তিলা ঘুঘু (spotted dove), সবুজ ঘুঘু (emerald dove), রাজ ঘুঘু (indian ring dove), রাম ঘুঘু (oriental turtle dove), ছোট ঘুঘু (little brown dove) ও লাল ঘুঘু (red turtle dove)।

তবে বাংলাদেশে বর্তমানে যে প্রজাতির ঘুঘু সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেটি হলো তিলা ঘুঘু বা spotted dove । বিদেশি জনপ্রিয় প্রজাতির ঘুঘু হলো ধূসরবর্ণের ঘুঘু (Grey Diamond Dove)। বর্তমানে অনেকে অস্ট্রেলিয়ান এই প্রজাতির ঘুঘুটি পালন করে থাকেন।

তিলা ঘুঘুর বৈশিষ্ট্য 

বাংলাদেশে যেসব প্রজাতির ঘুঘু রয়েছে তার মধ্যে বেশির ভাগ হলো তিলা ঘুঘু বা Spotted Dove । তিলা ঘুঘুর বৈজ্ঞানিক নাম Streptopelia chinensis। তিলা ঘুঘুর বৈজ্ঞানিক নামের বাংলা অর্থ করলে এর নাম হয় চীনের কণ্ঠীঘুঘু। এখন পর্যন্ত এর তিনটি উপপ্রজাতির খোঁজ পাওয়া গেছে।

এদের শরীরের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই প্রজাতির ঘুঘুর বুকের নিচে ধূসর রঙের পালক থাকে। বাদামী রঙের আকর্ষণীয় পালকে পিঠ পরিপূর্ণ থাকে। এছাড়াও গলায় কালো রঙের পালকের মাঝে সাদা ছোট ছোট ফোটা থাকে। যা দেখতে অনেকটা তিলের মতো। সেজন্য এর নাম হয়েছে তিলা ঘুঘু বা Spotted Dove । তিলা ঘুঘুর ঠোঁট বাদামী কালো বর্ণের হয়ে থাকে। 

তিলা ঘুঘু বিভিন্ন জায়গায় তেলিয়া ঘুঘু, ছিটে ঘুঘু নামে ও পরিচিত। এরা মানুষের বসত বাড়ির আশেপাশে ঝোপ ঝাড়ে কিংবা ছোট গাছে কাঠি দিয়ে বাসা বানায়। বর্তমানে বাংলাদেশে তিলা ঘুঘুর সংখ্যা অন্যসব ঘুঘুর থেকে অনেক বেশী।

ঘুঘু পাখি পালন পদ্ধতি

ঘুঘু আমাদের অতি পরিচিত একটি পাখি। এই পাখি খাঁচায় পালন করা ও শিকার করা বর্তমান আইন অনুযায়ী দন্ডনীয় অপরাধ। তবে আইন অনুযায়ী বিদেশি জাতের ঘুঘু খাঁচায় পালন করা যায়। 

বিদেশি যেসব প্রজাতির ঘুঘু আমাদের দেশে পালন করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো অস্ট্রেলিয়ান গ্রে ডায়মন্ড ডাভ বা ধূসরবর্ণের ঘুঘু। বর্তমানে ঘুঘু পালন একটি লাভজনক কাজ। অস্ট্রেলিয়ান এই প্রজাতির ঘুঘু বাংলাদেশের আবহাওয়ায় পালন করে অনেকে অর্থনৈতিক ভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। 

অস্ট্রেলিয়ান গ্রে ডায়মন্ড ডাভ বা ধূসরবর্ণের ঘুঘু পালন করা অত্যন্ত সহজ। ঘুঘু পালন করা কবুতরে পালন করার মতোই। একটি খাঁচা সংগ্রহ করে সেখানে খাবার খাওয়ার পাত্র ও পানির একটি পাত্র দিতে হবে। এরপর খাঁচার ভেতর ডিম পাড়ার জন্য মাটির অথবা প্লাস্টিক এর পাত্র দিতে হবে। পাত্রের উপর খড়কুটো দিতে হবে। এছাড়াও ঘুঘুর বসে থাকার জন্য একটি লাঠি টাঙিয়ে দিতে হবে। 

এছাড়া আর তেমন কোন কাজ নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে খাঁচার আকার যাতে একটু বড় হয়। ঘুঘুর তেমন কোন রোগ বালাই নেই। তাই অতি সহজে এই পাখি পালন করা যায়।

ঘুঘু পাখির খাবার তালিকা

ঘুঘু সাধারণত শস্য দানা ও বিভিন্ন ধরনের ফলের বীজ খেয়ে থাকে। এছাড়াও এরা বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও ফড়িং শিকার করে খায়। তবে খাঁচায় ঘুঘু পালন করলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শস্য দানা যেমন: সরিষার দানা, ধান, গম , চাউল ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। অথবা পাখির খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে ঘুঘু কে খেতে দিতে হবে। বাচ্চা ঘুঘু কে তার মা বাবা খাদ্য থলিতে তৈরি এক বিশেষ ধরনের লালা খাওয়ায় যা পিজিয়ন মিল্ক নামে পরিচিত।

ঘুঘু পাখির দাম

বর্তমান আইন অনুযায়ী ঘুঘু পাখি শিকার ও বেঁচা কেনা করে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিদেশি প্রজাতির ঘুঘু পালন করা ও বেচা কেনা করা যায়। আমাদের দেশে বিদেশি প্রজাতির যেসব ঘুঘু পালন করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো অস্ট্রেলিয়ান গ্রে ডায়মন্ড ডাভ বা ধূসরবর্ণের ঘুঘু। ঘুঘু পাখির নির্দিষ্ট কোন দাম নেই। তবে ১ জোড়া অস্ট্রেলিয়ান গ্ৰে ডায়মন্ড ঘুঘু্র বাচ্চার দাম ৫০০-৬০০ টাকা হতে পারে। এছাড়াও ১ জোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক অস্ট্রেলিয়ান গ্ৰে ডায়মন্ড ঘুঘু্র দাম ১৫০০-২০০০ টাকা হতে পারে। তবে স্থান ভেদে দামের পার্থক্য থাকতে পারে।

ঘুঘু পাখির উপকারিতা

ঘুঘু আমাদের অতি উপকারী একটি পাখি। ঘুঘু পাখির অনেক উপকারিতা রয়েছে। এই পাখি ফসলের ক্ষেত থেকে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও ফড়িং শিকার করে খায়। এতে ফসল ভালো হয়। কৃষক ও আর্থিক ভাবে লাভবান হয়।

এছাড়াও ঘুঘুর মাংসে রয়েছে অনেক পুষ্টি গুণ। যা মানুষের শরীরে রক্ত বৃদ্ধি করে। কিন্তু দেশীয় প্রজাতির ঘুঘু শিকার করা আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু বিদেশি প্রজাতির ঘুঘু পালন করা ও খাওয়া যায়। এভাবে ঘুঘু আমাদের অনেক উপকার করে থাকে, যা আমরা বুঝতে পারি না।

ঘুঘু পাখি খাওয়া কি জায়েজ

ইসলামে ঘুঘু পাখির মাংস খাওয়া জায়েজ। ঘুঘু পাখির মাংসে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে। যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

ঘুঘু পাখি শুভ না অশুভ

হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ঘুঘু হলো লক্ষী দেবীর ভক্ত। এজন্য তারা বিশ্বাস করে যে, ঘুঘু পাখি শুভ। ঘুঘু পাখি বাড়িতে বাসা বাঁধলে হিন্দুরা তা শুভ লক্ষণ হিসেবে ধরে নেয়।

এতক্ষণ আমরা ঘুঘু পাখি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানলাম। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই পাখি ও অন্যান্য সব পশুপাখির মতো বিলুপ্ত হতে বসেছে। একসময় আমাদের দেশের বনে জঙ্গলে, শহরে - গ্ৰামে সব জায়গায় এই পাখি প্রচুর দেখা গেলেও বর্তমানে খুবই কম দেখা যায়।

বিভিন্ন কারণে ঘুঘু পাখি দিন দিন কমে যাচ্ছে। শিকারি কতৃক ঘুঘু শিকার একটি অন্যতম কারণ। অনেকে শখের বশে বন্দুক দিয়ে এই পাখি শিকার করে থাকেন। মা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। এছাড়াও ঘুঘু পাখি ঝোপ ঝাড়ে ও ছোট গাছে এবং মানুষের বসত বাড়ির আশেপাশে বাসা বানায়। এজন্য মানুষজন সহজেই ঘুঘু শিকার করতে পারে। 
বর্তমানে বাংলাদেশে ৬ টি প্রজাতির ঘুঘু পাওয়া গেলেও, তিলা ঘুঘু ছাড়া অন্য ৫ টি প্রজাতির ঘুঘু খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে। ঘুঘু পাখির হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, অতিমাত্রায় শব্দ দূষণ, বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে বসত বাড়ি ও কলকারখানা স্থাপন।

আমাদের ঘুঘু পাখি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ঘুঘু পাখি একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।


Post a Comment

Previous Post Next Post