আমাদের সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে অসংখ্য পাখির বসবাস। এসব পাখির মধ্যে অন্যতম হলো বক। বক আমাদের সকলের নিকট অতি পরিচিত। বাংলার পথ-ঘাট, পুকুর জলাশয় সব জায়গাতেই বকের দেখা মেলে। জলের ধারে মাছ শিকারের জন্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বক পানির দিকে তাকিয়ে থাকে।
যেহেতু বক আমাদের সকলের নিকট অতি পরিচিত, সেজন্য এই পাখি সম্পর্কে নতুন করে বলার তেমন কিছুই নেই। তারপরও এখানে আমরা বক পাখি, বক পাখির বৈশিষ্ট্য, পরিচিতি এবং বকের খাবার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানব।
বক পাখির পরিচিতি
বক সাধারণত এর লম্বা গলা ও লম্বা পা এর জন্য অতি পরিচিত একটি পাখি। বক পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Ardeidae এবং বক পাখির ইংরেজি নাম Heron এছাড়াও ইংরেজিতে বক Crane ও egret নামেও পরিচিত। বক মূলতঃ উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি বসবাস করে। এরা সাধারণত মাছ ও বিভিন্ন ধরনের পোকা ধরে খায়।
বক আর্ডেইডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি পাখি। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি প্রাপ্ত বকের প্রজাতি রয়েছে ৬৪ টি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রায় ১৮ টি প্রজাতি দেখা যায়। এরা সাধারণত জলাশয় বা উপকূলীয় এলাকায় উঁচু গাছের মগডালে বাসা তৈরি করে। এরা দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। কিন্তু বক জোড়ায় জোড়ায় বসবাস করে। নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে এদেরকে দেখা গেলেও মরু ও মেরু অঞ্চলে এদেরকে দেখা যায় না।
বক পাখির বৈশিষ্ট্য
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে পৃথিবীতে বকের প্রায় ৬৪ টি প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে শুধু আমাদের দেশেই রয়েছে প্রায় ১৮ টি প্রজাতি। এসব প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যা এদেরকে একে অপরের সাথে আলাদা করেছে।
এরপরও বক পাখির সকল প্রজাতির মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। বক সাধারণত বিভিন্ন পুকুর বা জলাশয়ে জলের উপর বাঁশ বা গাছের ডালে বসে থাকে। এরা লম্বা ঠোঁট দিয়ে ছোট ছোট মাছ শিকার করে খায়। বকের গলা সাধারণত বেশ লম্বা আকৃতির হয়। গলার আকৃতি অনেকটা ইংরেজি S অক্ষর এর মতো। এছাড়াও এদের বেশ লম্বা আকৃতির পালকহীন নগ্ন পা রয়েছে।
বকের পুচ্ছ বা লেজে প্রায় ১২ টির মতো পালক রয়েছে । এদের লম্বা প্রশস্ত দুটি ডানা রয়েছে। এদের ডানাতে ১০ টি প্রাথমিক পালক থেকে থাকে। এরা সংঘবদ্ধভাবে উঁচু গাছের মগডালে বাসা তৈরি করে। সেখানে জোড়ায় জোড়ায় বসবাস করে।
গ্ৰীষ্ম - বর্ষা বকের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এরা সাধারণত মরা ঘাস ও শুকনো কাঠি দিয়ে এদের বাসা বানায়। এসব বাসা বক বছরের ও বেশি সময় পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকে। প্রজাতি ভেদে এরা কম বেশি ডিম দিয়ে থাকে। তবে সাধারণত বক ৩-৫ টি ডিম দিয়ে থাকে। এদের ডিমের রং গাঢ় সবুজ হয়। পালাক্রমে স্ত্রী ও পুরুষ বক ডিমে তা দেয়। কিছু দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
সদ্য ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চাদের এরা খাদ্য থলিতে হজমকৃত নরম খাবার খাওয়ায়। কিছুদিন পর একটু বড় হলে এরা এদের বাচ্চা দের মাছ শিকার করে এনে খাওয়ায়। ততদিন পর্যন্ত না এরা উড়তে ও শিকার করতে শেখে, ততদিন পর্যন্ত এদের বাবা মা এদের খাবার খাওয়ায়।
বকের বিভিন্ন প্রজাতি
একসময় আমাদের দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির বক দেখা যেত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। এরপরও বর্তমানে আমাদের দেশে মোট ১৮ প্রজাতির বক দেখা যায়। এদের মধ্যে অন্যতম কিছু প্রজাতি হলো, কানাবক, গো-বক, ছোট সাদাবক, মাঝারি সাদাবক, বড় সাদাবক, নিশিবক, বাঘাবক, ধূসর বক, বেগুনী বক এবং মহাকায় বক।
এসব প্রজাতির মধ্যে দুটি প্রজাতি নিশাচর, অর্থাৎ এরা রাতের বেলা খাবার শিকার করতে বের হয়। তাছাড়া বাকি সব প্রজাতি দিনের বেলা খাবার শিকার করে, অর্থাৎ এরা দিবাচর।আমাদের দেশে উপরোল্লেখিত প্রজাতি সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় ৩ টি প্রজাতি। এগুলো হলো কানাবক, গো-বক ও ছোট সাদাবক।
সাদা বকের বৈশিষ্ট্য
আমাদের দেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির বকের মধ্যে সাদা বক অন্যতম। একসময় আমাদের দেশের বিল, হ্রদ, নদী, জলাভূমি, মৌসুমি প্লাবনভূমি, ধানক্ষেত, নদীর মোহনা, জোয়ার-ভাটার খাঁড়ি ও অগভীর পানিতে প্রচুর সাদা বক দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কারণে এই সাদা বক বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে। সাদা বকের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এদের দেহ সাদা রঙের পালক দ্বারা ঢাকা থাকে। সাদা বকের দেহের ওজন ১-২.১ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের ডানার দৈর্ঘ্য ১.৬ মিটার থেকে ২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। অন্যান্য বকের মতো এরাও ব্যাঙ, মাছ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সাপ, ছোট সরিসৃপ, জলজ পোকা ও লার্ভা খেয়ে থাকে।
নিশি বক এর বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে যেসব প্রজাতির বক দেখা যায় তার মধ্য নিশি বক অন্যতম। এই বক নিশাচর, অর্থাৎ এরা রাতের বেলা বিচরণ বেশি করে ও খাবার শিকার করে। নিশি বক এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
নিশি বকের ইংরেজী নাম Night Heron আর বৈজ্ঞানিক নাম – Nycticorax nycticorax । নিশি বকের ওজন ৮০০ গ্ৰাম পর্যন্ত হতে পারে। আর এই প্রজাতির বকের শরীর লম্বায় ৬০-৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। নিশি বক সাধারণত ৪-৬ টি ডিম দিয়ে থাকে । এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস এরা প্রজনন করে থাকে।
এরা বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, পোকা , ব্যাঙ ইত্যাদি আহার করে। এরা সারা রাত জেগে এসব শিকার করে ও দিনের বেলা বিশ্রাম করে। এজন্য এরা নিশি বক নামে পরিচিত। এরা সাধারণত উঁচু গাছ ও বাঁশ ঝাড়ে বসবাস করে।
নিশি বকের শরীরে বিভিন্ন রঙের পালক রয়েছে। এদের মাথা, ঘাড় আর পিঠে সুরমা রঙের পালক থাকে। গলায়, বুকে ও পেটে সাদা রঙের পালক থাকে । এছাড়াও মাথায় সাদা রঙের একটি ঝুটি থাকে। নিশি বক অনেকে শখ করে খাঁচায় পালন করে থাকে।
বক খাওয়া কি জায়েয
যেসব পাখি সাধারণত কোন পশু বা পাখির উচ্ছিষ্ট খেয়ে থাকে এবং পায়ে শিকার ধরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তা খেয়ে থাকে এমন পাখির মাংস খাওয়া জায়েজ নয়। কিন্তু বকের মধ্যে যেহেতু এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নেই অর্থাৎঠোঁটের সাহায্যে শিকার চেপে ধরে খায়, খুঁচিয়ে খায় না। সেহেতু বকের মাংস খাওয়া জায়েজ।
এছাড়াও বকের মাংস অত্যন্ত পুষ্টিকর। এতে মানুষের শরীরের জন্য উপকারী বিভিন্ন উপাদান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বকসহ অন্য যেকোন পাখি শিকার করা নিষিদ্ধ।
বকের মাংসের উপকারিতা
আমাদের দেশে বক পাখি শিকার আইনত নিষিদ্ধ। তবে অনেকে বক পালন করে থাকেন। সেসব বকের মাংস তারা খেয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন বকের মাংস অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। মানুষের শরীরের জন্য উপকারী এই পাখির মাংস। কেউ কেউ মনে করেন বকের মাংস খেলে চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পায়।
বকের বাসস্থান কোথায়
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বক পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি বকের আবাস নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে।বক সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করতে পছন্দ করে বক। এরা যেখানে জলাশয় ও পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে তার আশেপাশে বসবাস করে। খাবারের সংকট হলে অর্থাৎ খরা মৌসুমে খাদ্যের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
বক কোথায় বাসা বাঁধে
বক সাধারণত দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। এরা মূলত বিশাল আকৃতির বটগাছে এদের কলোনি তৈরি করে এবং সেখানে বাসা বানায়। এরপর বছরের পর বছর একসাথে সেখানে বসবাস করে। এছাড়াও এরা বাঁশ ঝাড়ে ও বাসা বাঁধে
বক পাখির খাদ্যাভ্যাস
বক পাখির খাদ্যাভ্যাস হলো এরা ব্যাঙ, মাছ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সাপ, ছোট সরিসৃপ, জলজ পোকা ও এদের লার্ভা এবং মাছি খেয়ে থাকে। এছাড়াও বক পাখি ফসলের ক্ষতিকর পোকা ধরে খায়। যা কৃষকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
বক পাখির স্বভাব
সকালবেলা আমরা কোন পুকুর পাড় অথবা জলাশয় এর কাছে গেলে বক পাখি দেখতে পারব। মাছ ধরার আশায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে বক। যেই জল একটু নড়ে উঠে ওমনি বক তার তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে মাছ শিকার করে ফেলে। এরা দলবদ্ধ ভাবে এক জায়গায় বসে ডাকাডাকি করে। এদের দৃষ্টি খুব তীক্ষ হয়।
আমরা এতক্ষণ বক পাখি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানলাম। বক পাখির বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন ধরনের বক পাখি, বক পাখির আবাস, এদের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বক পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। যেমন শিকারী কতৃক বক শিকার, পানি দূষণ, বড় বড় গাছপালা কেটে ফেলা, বিভিন্ন জলাশয় ও খালবিল ভরাট করা, ফসলের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করা এসব কারনে বক দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের বক পাখি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
Post a Comment