দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি।

বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন ( Bangladesh Anti Corruption Commission) বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখানে দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে জানব।
দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি।


বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন

দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি। দুর্নীতির কালো থাবায় সমাজ আজ বিপর্যস্ত, বিশ্ব বিবেক প্রতারিত। সাধারণ অর্থে দুর্নীতি বলতে নীতিবিহীন কাজ করাকে বোঝায়। আক্ষরিক অর্থে দুর্নীতি হচ্ছে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ। 

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দেশটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ ঘটে দুর্নীতি। এ দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পর থেকে দুর্নীতি দমন ব্যুরো (Bureau of Anti corruption) কাজ করে আসছিল। কিন্তু এটি একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় দেশের সাধারণ নাগরিকরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। দাতাগোষ্ঠীও চাপ দিতে থাকে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের জন্য। 

অতঃপর ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আইন মোতাবেক ২০০৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালের ৯ মে।

বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠন

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত। এর প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত। তবে প্রয়োজনে দেশের যেকোনো স্থানে এর শাখা স্থাপন করা যাবে। তিনজন কমিশনারের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে রাষ্ট্রপতি চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেন।

কমিশনারগণের কার্যকাল চার বছর। পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি কমিশনার পদে নিয়োগের সুপারিশ করবে। এই কমিটির সদস্যরা হবেন প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক ও হাইকোর্টের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের মধ্যে কেউ যদি রাজি না হন তাহলে বর্তমান সচিবই কমিটির সদস্য হবেন।

কমিশনারদের যোগ্যতার মাপকাঠি হচ্ছে আইন, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার অথবা শৃঙ্খলা বাহিনীতে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা। ঋণখেলাপি, দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত, বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ডপ্রাপ্ত অথবা আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তিগণ অযোগ্য বিবেচিত হবেন। কমিশনের সদস্যরা (কমিশনার) কর্মাবসানের পর প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।

কমিশনারদের পারিশ্রমিক, ভাতা ও সুবিধাদি সরকার নির্ধারণ করবে। সাচিবিক দায়িত্ব পালনের জন্য কমিশন একজন সচিব নিযুক্ত করবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারীও থাকবে। তাদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।

বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যাবলি

দুর্নীতি দমন কমিশন অপরাধসমূহ অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা, মামলা দায়ের ও পরিচালনা, দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, রাষ্ট্রপতিকে সুপারিশ প্রদান, গণসচেতনতা গড়ে তোলা, দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করন প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

কমিশন যে সকল কার্য সম্পাদন করতে পারবে—

১. দুর্নীতি সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ স্বপ্রণোদিত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান;

২. দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর তফসিলে উল্লিখিত অপরাধসমূহের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা;

৩. দুর্নীতি সম্পর্কিত অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার ভিত্তিতে আইনের অধীন মামলা দায়ের ও পরিচালনা; 

৪. দুর্নীতি দমন বিষয়ে আইন দ্বারা কমিশনকে অর্পিত যেকোনো দায়িত্ব পালন করা;

৫. নীতি প্রতিরোধের বিষয়ে গবেষণা পরিকল্পনা তৈরি করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে করণীয় সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ পেশ করা;

৬. দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য কোনো আইনের অধীন স্বীকৃত ব্যবস্থাদি পর্যালোচনা এবং কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ পেশ করা;

৭. আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা এবং তদানুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ পেশ করা;

৮. কমিশনের কার্যাবলি বা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এমন সকল বিষয়ের ওপর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা ইত্যাদি। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা;

৯. দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা, 

১০. দুর্নীতির অনুসন্ধান, তদন্ত, মামলা দায়ের, তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমোদন পদ্ধতি নির্ধারণ করা;

১১. দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত অন্য যে কোনো কার্য সম্পাদন করা। প্রতি পঞ্জিকা বছরের মার্চ মাসের মধ্যে কমিশন পূর্ববর্তী বছরে সম্পাদিত তার কার্যাবলি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ
করবে। প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর রাষ্ট্রপতি তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবেন; এবং

১২. দুর্নীতি দমন আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কমিশন রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদনক্রমে এবং সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বিধি প্রণয়ন করতে পারবে।

বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা


দুর্নীতি দমন কমিশন যেসব ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা উল্লেখ করা হলো।

তদন্তকার্যে কমিশনের বিশেষ ক্ষমতা

দুর্নীতি সম্পর্কিত কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্তের ক্ষেত্রে কমিশনের নিম্নলিখিত ক্ষমতা থাকবে, যেমন: 

i. সাক্ষীর সমন জারি ও উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং শপথের মাধ্যমে সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা;

ii. কোনো দলিল উদ্‌ঘাটন এবং উপস্থাপন করা;

iii. শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ;

iv. কোনো আদালত বা অফিস হতে পাবলিক রেকর্ড বা তার অনুলিপি তলব করা:

v. সাক্ষীর জিজ্ঞাসাবাদ এবং দলিল পরীক্ষা করার জন্য পরোয়ানা জারি করা; এবং

vi. আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, নির্ধারিত অন্য যে কোনো বিষয়।

কমিশন যেকোনো ব্যক্তিকে অনুসন্ধান বা তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো তথ্য সরবরাহ করার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে এবং অনুরূপভাবে নির্দেশিত ব্যক্তি তার হেফাজতে রক্ষিত উক্ত তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবেন। 

কোনো কমিশনার বা কমিশন হতে বৈধ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তাকে উপধারা (১) এর অধীন ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি বাধা প্রদান করলে বা উক্ত উপধারার অধীন প্রদত্ত কোনো নির্দেশ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তি অমান্য করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

তদন্তের ক্ষমতা

ফৌজদারী কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, আইনের অধীন ও তার তফসিলে বর্ণিত অপরাধসমূহ কেবলমাত্র কমিশন কর্তৃক তদন্তযোগ্য হবে। উল্লিখিত অপরাধসমূহ তদন্তের জন্য কমিশন, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা তার অর্ধস্তন কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপরাধ তদন্তের বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার ক্ষমতা থাকবে। কমিশনারগণেরও আইনের অধীন অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা থাকবে।

গ্রেফতারের ক্ষমতা

আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন, কমিশন হতে এতদুদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ থাকে যে, কোনো ব্যক্তি তাঁর নিজ নামে বা অন্য কোনো ব্যক্তির নামে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির মালিক বা দখলদার যা তার ঘোষিত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, তা হলে উচ্চ কর্মকর্তা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবেন।

 দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা

আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে কমিশনারগণ আইনের অধীন দায়িত্ব পালন ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।

কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা

সরকার প্রতি অর্থবছর কমিশনের ব্যয়ের জন্য তার অনুকূলে নির্দিষ্টকৃত অর্থ বরাদ করবে এবং অনুমোদিত ও নির্ধারিত খাতে উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ হতে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করা কমিশনের জন্য আবশ্যক হবে না। বিধান দ্বারা সংবিধানে ১২৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মহাহিসাব নিরীক্ষকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

বাংলাদেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে। তারা মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকমতো পূরণ করতে পারে না। অথচ এই দেশে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি করে বিত্তশালী হচ্ছে। 

দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে দেশকে রক্ষা করা। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে ভাবেই দুর্নীতি হোক না কেন, এই আইন ব্যবহার করে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনানুযায়ী সাক্ষী তলব করা, অভিযোগ সম্পর্কে অভিযুক্তকে জেরা করা, বেসরকারি দলিলপত্র উপস্থাপন করা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। 

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এ বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন অথবা এখন দুর্নীতি দমন কমিশনার যেকোনো স্থানে তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবেন। 

দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যে, তার অধস্তন যেকোনো অফিসার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করতে পারবেন অথবা আইন বা নিয়ম লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারবেন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে বলা হয়েছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, এককভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন ও নির্মূল করা সম্ভব নয়। 

প্রথমত, দুর্নীতি দমনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও কার্যক্রম ও শক্তিশালী করতে হবে। সবশেষে দুর্নীতির তথ্য যারা প্রকাশ করবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে, আইনগতভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

কোনো দেশে দুর্নীতি গড়ে ওঠে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তাই সমূলে দুর্নীতি নির্মূল এক দিনেই সম্ভব নয় কিন্তু আমরা আজ থেকেই যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী না হই, তাহলে আমাদের সব চেষ্টাই বৃথা যাবে, যা আমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয় । এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন, দুর্নীতি দমনের জন্য সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

Post a Comment

Previous Post Next Post